ব্লগ সংরক্ষাণাগার

বুধবার, ১৩ মে, ২০০৯

বাংলাদেশে ইউরো-মার্কিন নৈরাজ্যবাদের প্রাসঙ্গিকতা

ফেসবুকে চমস্কির "ভবিষ্যতের সরকার" নিয়ে অনুবাদটার পরিপ্রেক্ষিতে প্রিয় বান্ধব ফাহমিদুল হক প্রশ্ন করেছেন:

"প্রত্যেক নৈরাজ্যবাদীই একেকজন সমাজতন্ত্রী, কিন্তু প্রত্যেক সমাজতন্ত্রীই একেকজন নৈরাজ্যবাদী নন।"

"এ-কথা বিশ্বাসযোগ্য যে, মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের আদলে প্রকাশিত ও বিকশিত ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী ভাবাদর্শগুলো অর্জন করা সম্ভব।"

মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র বা নৈরাজ্যবাদের আদলে ধ্রুপদী উদারনীতি ভাবাদর্শ অর্জনের প্রচেষ্টাই ভবিষ্যতের সরকারগুলোকে নিতে হবে, মানবমুক্তির জন্য।

চমস্কির অবস্থান এটাই, আমার পাঠ। অনুমান করি রাজনীতি-চিন্তক/কর্মী হিসেবে আপনার অবস্থানও তাই। চমস্কির এই বক্তুতাকে বেসিক টেক্সট ধরে এখন আপনার একটা পর্যালোচনা/বিশ্লেষণ দাবি করছি। নৈরাজ্যবাদের প্রবক্তারা ইউরোপীয়ান, এর নিদর্শন ইউরোপেই দেখা গেছে, এর সমকালীন প্রচারক চমস্কি আমেরিকান। এখন বাংলাদেশে বা তৃতীয় বিশ্বে একে কীভাবে কনটেকচুয়ালাইজ করা যাবে?


এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নিচে বাংলাদেশে ইউরো-মার্কিন নৈরাজ্যবাদের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করছি।

এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে চমস্কির আন্দাজের একটা দিক। এটা কোনো মডেল নয়। তদানিন্তন রাশিয়ার মতো পশ্চাৎপদ দেশে নৈরাজ্যবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন পিতর ক্রপোৎকিন। অন্য রচনায় আমিও বলেছি, আমাদের দেশের ইতিহাসে অচেতন অ্যানার্কি আছে। ভাষা আন্দোলনে, গণঅভ্যুত্থানে, মুক্তিযুদ্ধে, রূপকথায়, ফোকলোরে, হাজারো বিদ্রোহে, পুরানে, সুফিতত্ত্বে নৈরাজ্যে স্পষ্ট আভাস আছে। শিবপুরাণে স্বাভাবিক বিশুদ্ধতার ধারণা নৈরাজ্যেরই ধারণা। আরো এক্সপ্লোর করা প্রয়োজন। আমরা করবও। করছিও ইতোমধ্যে।

আচ্ছা। চমস্কির নৈরাজ্যবাদের একটা তত্ত্ব হলো, এটা উচ্চনীচ-কর্তৃত্বক্রমতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বৈধতাকে অস্বীকার করা। যাবতীয় কর্তৃত্ব-ক্রমতন্ত্রকে যথাসম্ভব তীব্রভাবে আক্রমণ করে তাঁর অবৈধতা প্রতিপন্ন করার কাজটাই নৈরাজ্যবাদের কাজ। বাংলাদেশে এ ধরনের কাজ দাঁড় করানো সম্ভব। বড় বড় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব।

প্রথমত, এখানে দরকার নৈরাজ্য ও স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্রের ধারণাগুলোর বিপুল প্রচার--আগামী ৫০ বছর ধরে, কমপক্ষে। সমস্ত--অঢেল পরিমাণ--নৈরাজ্যবাদী রচনা সোজাসাপ্টা বাংলায় অনুবাদ করা ও প্রচার করা দরকার। তাহলেই দেখা যাবে, নৈরাজ্যবাদী গ্রুপগুলো নিজে থেকেই গড়ে উঠতে শুরু করবে। বাকুনিনের কথা: একদিন ঘুম থেকে উঠে বিপ্লব হয় না। নতুন সমাজের বীজ বর্তমান এই সমাজের মধ্যেই গড়ে তুলতে শুরু করতে হবে। এখনই। নতুন নৈরাজ্যবাদী ধারার স্বাধীন সংগঠনগুলোই হবে সেই সমাজের বীজ। স্বাধীনতার বীজানু। এরকম অজস্রমুখী প্রচার ও সংগঠিত তৎপরতার মাধ্যমে উন্নততর স্বাধীন সমাজের জমি তৈরি করতে থাকতে হবে। সেটাই নৈরাজ্যবাদীদের কাজ। নৈরাজ্যবাদীরা বলশেভিকদের মতো নিজেরাই বিপ্লবের দায়দায়িত্ব নিয়ে নেন না। জমিতে জল দিত থাকলে এবং কর্তৃত্ব-প্রশাসন-বলপ্রয়োগকে যতভাবে পারা যায় সংগঠিত ধারায় চ্যালেঞ্জ করতে থাকলে সাধারণ জনসাধারণ কখন গণেশ উল্টে দেবেন কেউ সেটা ছক কষে বলে দিতে পারেন না। এবং এটাই কাম্য। এটা চমস্কির নৈরাজ্যবাদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য মানবসমাজ মাত্রের জন্যই প্রযোজ্য। বাংলাদেশেও।

ছোটো ছোটো স্বাধীন অজস্র এরকম সংগঠনের প্রচার ও প্রত্যক্ষ-তৎপরতা সমাজের চিন্তায় ও বাস্তবতায় সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে শুরু করবে। আমাদের আগস্ট-বিদ্রোহ জরুরি অবস্থার নিষ্পেষণকে অনেকখানি রুখে দিতে পেরেছিল। ঐ বিদ্রোহটা 'আচমকা' ঘটলেও তার পেছনে ছিল রাবি-তে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রচার ও সাংগঠনিক কাজ। এর চেয়ে আরো অনেক বড় আন্দোলন সম্ভব। রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপরায়ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনঠাসা করতে থাকা এবং তার মাধ্যমে একদিকে সমাজ ও ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতার সীমা বাড়াতে থাকা এবং অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব জীবনের উন্নতি অর্জন ও অধিকার আদায়ের মাধ্যমে সমাজ স্বাধীনতা-সংহতি-সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ধারণা, অর্থাৎ "খাঁচার মেঝেকে প্রসারিত করা"র ধারণা চমস্কির নৈরাজ্যবাদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য।

এগিয়ে যেয়ে কী চেহারা সমাজ নেবে তার সুনির্দিষ্ট রূপ এখনই নির্নয় না-করাটা, নির্ণয় করাকে অপ্রয়োজনীয় ও অসম্ভব জ্ঞান করাটা চমস্কির নৈরাজ্যবাদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য।

চমস্কির নৈরাজ্যবাদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য তাঁর মনুষ্যস্বভাব-তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ জন্মগতভাবে মানুষ স্বাধীন ও সৃজনশীল। বাকুনিনের তরফে চমস্কি দেখান, স্বাধীনতার স্পৃহা এবং বিদ্রোহের বাসনা মানুষের চিরন্তন জৈবিক বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের অনুকূল সমাজ গঠনের পথে বাধা হচ্ছে পুঁজিবাদী মালিকানা-কাঠামো এবং তার বলপ্রয়োগের রাষ্ট্রীয়-আইনগত-কর্তৃত্ব-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ, অসমতা ও কর্তৃত্ব। চূড়ান্ত বিপ্লবের মাধ্যমে উভয়কে উচ্ছেদ করে স্বাধীন মানুষের স্বাধীন ফেডারেশনসমূহ দ্বারা মুক্ত মানুষে মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার পথে যা যা করা যায় করাটাই এই মুহূর্তে নৈরাজ্যবাদীদের কাজ।

চমস্কির নৈরাজ্যবাদের এইসব বৈশিষ্ট্য আমাদের মতো দেশে নৈরাজ্যবাদী ধারায় বা মুক্তিমুখীন সমাজতন্ত্রের ধারায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ধ্যানধারণা ['থিওরি' নয়] হিসেবে কাজ করে। এগুলো সমাজ-নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্্য নয়, সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য।

চমস্কির নৈরাজ্যবাদের আরও বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলো এই মুহূর্তে না-তুললেও চলে।

বাকুনিন, রকার এবং নোম চমস্কির নৈরাজ্যবাদ স্রেফ ফলো না-করে আমাদের অরাজপন্থা আমাদের নিজেদেরই তৈয়ার করা বাংলাদেশে নৈরাজ্যবাদীদের কাজ। কাজটা প্রত্যক্ষ শ্রমিক আন্দোলন ধরে, সিনেমা ধরে, কবিতা, প্রবন্ধ, শিক্ষকতা, মিছিল, সমাবেশ, আলোচনা, ছবি আঁকা, গান--অজস্র ধারায় করা সম্ভব। সমমনাদের মধ্যে বৃহত্তর ফেডারেশন গড়ে তোলা সম্ভব।

আমাদের মতো দেশে দীর্ঘ দিনের বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে নৈরাজ্যবাদের পৃথক পৃথক ভাষ্য গড়ে ওঠাটাও স্বাভাবিক। যা ইউরোমার্কিন নৈরাজ্যবাদের পর্যালোচনাও দাঁড় করিয়ে দেবে।


চলবে আপাতত, ফাহমিদ? পরে আমরা 'মানুষ' পত্রিকায় "নোম চমস্কির নৈরাজ্যবাদ, আমাদের অরাজপন্থা" শিরোনামে এসব নিয়ে আমার ধারণাগুলো আরও গুছিয়ে, আরও বিস্তৃতভাবে হাজির করতে পারব আশা করি। তার আগে এখন আরও প্রশ্ন-মত-বিশ্লেষণ নিয়ে কথা উঠলে বরং ভালোই। আমরা তৈরি হয়ে উঠতে পারব।

ফেসবুক: রাজশাহী: ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০০৯: http://www.facebook.com/note.php?note_id=75487567911

কোন মন্তব্য নেই: